
প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙা থেকে শুরু করে রাতের নিস্তব্ধতায় ডুবে যাওয়া পর্যন্ত একজন নারীর পৃথিবীটা অসংখ্য ছোট–বড় দায়িত্ব আর ভালোবাসার সুতোয় বোনা। সন্তানের মুখের হাসি, পরিবারের প্রয়োজন মেটানো, আর সংসারের হাজারো কাজের ভিড়ে তার নিজের জন্য ভাবার ফুরসত মেলে সামান্যই। কিন্তু সেই সামান্য অবসরে, কিংবা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন নিজের চেহারায় সময়ের ছাপ দেখতে পান, তখন তার মনে কোন ভাবনাগুলো উঁকি দেয়?
দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের ওপারে যে অনন্ত জীবন—আখিরাত—রয়েছে, সেই জীবন নিয়ে একজন নারীর ভাবনাগুলো কেমন? তার আশা, তার ভয় আর তার প্রস্তুতিগুলো কেমন হয়? চলুন, একজন নারীর একান্ত জগত থেকে আখিরাতের ভাবনাগুলো একটু বোঝার চেষ্টা করি।
১. দুনিয়ার সম্পর্কের মায়া এবং আখিরাতের পুনর্মিলন
একজন নারীর জীবন আবর্তিত হয় তার সম্পর্কগুলোকে ঘিরে। বাবা–মা, স্বামী, সন্তান—এরাই তার পৃথিবী। তাই আখিরাতের কথা ভাবলে তার মনে প্রথম যে প্রশ্নটি আসে, তা হলো: “আমার এই ভালোবাসার মানুষগুলোকে কি আমি সেখানে আবার ফিরে পাবো?” দুনিয়াতে সে তার স্বামীর জন্য নিজেকে সাজিয়েছে, তার সন্তানের জন্য রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। তার অবচেতন মন তাই স্বপ্ন দেখে জান্নাতের। যেখানে সে তার ঈমানদার স্বামীকে পাবে রাজার বেশে, আর তার নেককার সন্তানরা থাকবে তার চোখের শীতলতা হয়ে। এই পুনর্মিলনের আশা তাকে দুনিয়ার সব কষ্ট সহ্য করার শক্তি জোগায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“স্থায়ী জান্নাত, তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের বাবা–মা, পতি–পত্নী ও সন্তানদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল তারাও। আর ফেরেশতারা তাদের কাছে প্রতিটি দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে।“ (সূরা আর–রাদ: ২৩)
এই আয়াতটি একজন নারীর হৃদয়ে সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা হয়ে বাজে।
২. জান্নাতের হুর এবং একজন দুনিয়ার নারীর মর্যাদা
জান্নাতের বর্ণনায় পুরুষদের জন্য ‘হুর‘-এর কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে অনেক নারীর মনেই কৌতূহল এবং কিছুটা দ্বিধা কাজ করে। সে ভাবে, “আমার স্বামীর জন্য যদি অন্য কেউ থাকে, তাহলে আমার অবস্থান কী হবে?” ইসলাম এই দ্বিধার এক সুন্দর সমাধান দিয়েছে। আলেমগণ বলেন, দুনিয়ার ঈমানদার নারীরা তাদের ইবাদত, ধৈর্য এবং ত্যাগের বিনিময়ে জান্নাতে হুরদের চেয়েও বহুগুণে বেশি সুন্দরী এবং মর্যাদাবান হবেন। তারা হবেন জান্নাতের “রাণী“। তাদের সৌন্দর্য হবে অতুলনীয়, আর তাদের প্রতি স্বামীর ভালোবাসা হবে নিখাদ ও চিরস্থায়ী। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ঈর্ষা বা অধিকারবোধের ঊর্ধ্বে জান্নাতের সম্পর্ক হবে পবিত্র এবং পরিতৃপ্তির। এই বিশ্বাস একজন নারীকে দুনিয়ার ছোট ছোট কষ্টগুলোকে তুচ্ছ করে আখিরাতের বিশাল পুরস্কারের জন্য প্রস্তুত হতে অনুপ্রাণিত করে।
৩. নিজের আমল এবং আল্লাহর সামনে একাকী দাঁড়ানোর ভয়
একজন নারী যেমন তার ভালোবাসার মানুষগুলোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, তেমনি তার মনে একটি ভয়ও কাজ করে। কিয়ামতের দিন তাকেও যে তার আমলনামা নিয়ে আল্লাহর সামনে একাকী দাঁড়াতে হবে! সারাদিনের ব্যস্ততায় হয়তো তার নামাজে তাড়াহুড়ো হয়ে গেছে, সন্তানের প্রতি রাগের মাথায় হয়তো কটু কথা বলে ফেলেছেন, অথবা মনের অজান্তেই হয়তো গীবত করে ফেলেছেন। রাতের নিস্তব্ধতায় এই ছোট ছোট ভুলগুলো তার মনে কাঁটার মতো বিঁধে। সে ভাবে, “আমার এই ত্রুটিগুলো কি আল্লাহ ক্ষমা করবেন?” তার এই ভয় কিন্তু হতাশা থেকে আসে না, বরং আসে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁকে হারানোর ভয় থেকে। এই ভয়ই তাকে তওবা করতে শেখায়, পরের দিনটি আরও সুন্দরভাবে শুরু করার জন্য শক্তি জোগায়। সে তার প্রতিটি সিজদায় নিজের এবং পরিবারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।
৪. দুনিয়ার সাজসজ্জা বনাম আখিরাতের স্থায়ী সৌন্দর্য
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একজন নারী যখন তার রূপচর্চা করে, তখন একজন ঈমানদার নারীর ভাবনা শুধু দুনিয়ার সৌন্দর্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সে জানে, এই সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী। তাই সে বাহ্যিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি তার অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য—তার চরিত্র, তার পর্দা, তার লজ্জাশীলতা—নিয়েও ভাবে। সে তার সৌন্দর্যকে শুধুমাত্র তার মাহরাম পুরুষদের (যাদের সাথে বিয়ে হারাম) জন্য সীমাবদ্ধ রাখে, কারণ সে জানে, এই পর্দার বিনিময়ে আল্লাহ তাকে আখিরাতে এমন এক নূর বা আলো দান করবেন যা কখনো ম্লান হবে না। তার কাছে দুনিয়ার প্রশংসা বা লাইমলাইটের চেয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অনেক বেশি মূল্যবান।
উপসংহার: আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের তীব্র আকাঙ্ক্ষা
দিনশেষে, একজন মুমিনা নারীর আখিরাতের সবচেয়ে বড় ভাবনা হলো তার রবের সাথে সাক্ষাতের মুহূর্তটি। কেমন হবে সেই মুহূর্ত, যখন حجاب বা পর্দা সরিয়ে দেওয়া হবে এবং সে তার মহান রবকে প্রথমবারের মতো দেখতে পাবে? যে আল্লাহকে সে না দেখেই ভালোবেসেছে, যার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছে, তাঁর দিদার (সাক্ষাৎ) পাওয়ার অনুভূতি কেমন হবে? জান্নাতের সব নিয়ামতের চেয়েও এই একটি মুহূর্ত তার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এই তীব্র আকাঙ্ক্ষাই তার জীবনের চালিকাশক্তি। এটিই তাকে শেখায় দুনিয়ার সব মোহ এবং কষ্টকে তুচ্ছ করে শুধু আল্লাহর জন্য বেঁচে থাকতে। এক কথায়, আখিরাত একজন নারীর কাছে শুধু ভয় বা পুরস্কারের নাম নয়; এটি তার আশা, ভালোবাসা, স্বপ্ন এবং তার চূড়ান্ত গন্তব্যের এক প্রতিচ্ছবি।