
“হাতে একদম সময় নেই,” “দিনটা কীভাবে যে শেষ হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না,” “অনেক কাজ জমে গেছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না“—এই কথাগুলো কি আপনার জীবনের নিয়মিত অংশ হয়ে গেছে?
আধুনিক জীবনে আমরা সবাই সময়ের অভাবে ভুগি। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, যে সময়কে আমরা এত অবহেলা করি, সেই সময়ের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে? কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা আমাদের যে কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রশ্ন করবেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো—আমরা আমাদের জীবনকাল বা সময়কে কোন কাজে ব্যয় করেছি।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “দুটি নিয়ামত এমন আছে, যে ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই প্রতারিত (বা উদাসীন): সুস্থতা এবং অবসর সময়।“ (সহিহ বুখারী)
সময় আল্লাহর দেওয়া এক অমূল্য আমানত। এর সঠিক ব্যবহার দুনিয়া ও আখিরাত—উভয় জাহানেই সফলতার চাবিকাঠি। চলুন, জেনে নেওয়া যাক সময় ব্যবস্থাপনার সেই সেরা ৫টি ইসলামিক মূলনীতি, যা আমাদের জীবনকে বদলে দিতে পারে।
১. প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য বা নিয়তকে স্পষ্ট করা
ইসলামে প্রতিটি কাজের মূল্য নির্ধারিত হয় তার নিয়তের উপর। আপনি যখন আপনার দিনের প্রতিটি কাজের সাথে একটি মহৎ উদ্দেশ্য যুক্ত করবেন, তখন আপনার সাধারণ কাজগুলোও ইবাদতে পরিণত হবে।
যেমন, আপনি যখন অফিসে যাচ্ছেন, তখন আপনার নিয়ত শুধু টাকা উপার্জন নয়, বরং হালাল রিজিকের মাধ্যমে নিজের পরিবারকে ভরণপোষণ করা। আপনি যখন পড়াশোনা করছেন, তখন আপনার নিয়ত শুধু একটি ডিগ্রি অর্জন নয়, বরং সেই জ্ঞান দিয়ে উম্মাহর সেবা করা।
করণীয়:
প্রতিদিন সকালে দিনের কাজগুলো শুরু করার আগে একবার ভাবুন, আপনি কেন এই কাজগুলো করছেন। আপনার কাজের উদ্দেশ্য যখন হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তখন আপনি অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকবেন। আপনার প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান হয়ে উঠবে।
২. সালাতকে কেন্দ্র করে দিনের পরিকল্পনা সাজানো
একজন মুসলিমের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হলো পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। সময় ব্যবস্থাপনার জন্য এর চেয়ে শক্তিশালী কোনো টুল আর হতে পারে না। আপনি যদি আপনার দিনের কাজগুলোকে নামাজের ওয়াক্ত অনুযায়ী ভাগ করে নেন, তাহলে আপনার দিনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি সুশৃঙ্খল রুটিনে চলে আসবে।
উদাহরণস্বরূপ:
- ফজর থেকে যোহর: দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন কাজগুলো এই সময়ে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।
- যোহর থেকে আসর: তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বা মধ্যম মানের কাজগুলো করুন।
- আসর থেকে মাগরিব: দিনের শেষ মুহূর্তের কাজ, পরিবারের সাথে সময় কাটানো বা ব্যক্তিগত কাজগুলো করুন।
- মাগরিব থেকে এশা: দিনের পর্যালোচনা, কুরআন তেলাওয়াত বা পরিবারের সাথে রাতের খাবার।
- এশার পর: অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থেকে দ্রুত ঘুমানোর প্রস্তুতি নিন।
এই কাঠামোটি আপনাকে একটি প্রাকৃতিক ডেডলাইন দেবে এবং সময়মতো কাজ শেষ করতে সাহায্য করবে।
৩. অগ্রাধিকার নির্ণয় করা: কোনটি জরুরি এবং কোনটি গুরুত্বপূর্ণ?
আমাদের জীবনে অনেক কাজ থাকে, কিন্তু সবগুলো সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইসলাম আমাদের শেখায় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করতে। অর্থাৎ, যে কাজটি বেশি জরুরি এবং আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দনীয়, সেটি আগে করা।
ইসলামিক অগ্রাধিকারের ক্রম:
- ফরজ কাজ: যেমন—পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজা।
- ওয়াজিব ও সুন্নাহ: যেমন—পরিবারের হক আদায় করা, সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
- মুস্তাহাব কাজ: ভালো এবং ঐচ্ছিক কাজ।
- মুবাহ বা বৈধ কাজ: দুনিয়াবি প্রয়োজনীয় কাজ।
- মাকরুহ ও হারাম কাজ: যা বর্জনীয়।
করণীয়:
আপনার দৈনন্দিন কাজের একটি তালিকা তৈরি করুন এবং সেগুলোকে উপরের অগ্রাধিকার অনুযায়ী সাজান। সবসময় ফরজ কাজগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন। এটি আপনাকে অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করা থেকে বাঁচাবে এবং নিশ্চিত করবে যে আপনার প্রধান দায়িত্বগুলো পালিত হচ্ছে।
৪. সকালের বরকতময় সময়কে কাজে লাগানো (The Golden Hours)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর উম্মতের জন্য ভোরের সময়ে বরকতের দোয়া করেছেন। ফজরের পরের সময়টুকু হলো দিনের সবচেয়ে উৎপাদনশীল সময়। এই সময় মস্তিষ্ক থাকে সতেজ, পরিবেশ থাকে শান্ত, এবং আধ্যাত্মিক আবহ বিরাজ করে।
করণীয়:
ফজরের নামাজ পড়ে না ঘুমিয়ে সেই সময়টিকে আপনার সবচেয়ে কঠিন বা সৃজনশীল কাজের জন্য বরাদ্দ করুন। হতে পারে সেটা পড়াশোনা, অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রজেক্ট, বা কুরআন গবেষণা। এই সময়ে অল্প পরিশ্রমে আপনি অনেক বেশি কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন এবং সারাদিনের জন্য একটি ইতিবাচক গতি তৈরি হবে।
৫. অপ্রয়োজনীয় কাজ ও সঙ্গ ত্যাগ করা
সময় নষ্ট হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অপ্রয়োজনীয় আড্ডা, সোশ্যাল মিডিয়ার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং এমন মানুষের সঙ্গ, যারা আপনাকে ভালো কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না।
কুরআনে সফল মুমিনদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন:
“এবং যারা অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকে।“ (সূরা আল–মুমিনুন: ৩)
করণীয়:
- ডিজিটাল ডিটক্স: প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (যেমন: রাতের খাবারের সময় বা ঘুমানোর এক ঘণ্টা আগে) আপনার ফোন বা ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন।
- ভালো সঙ্গ নির্বাচন: এমন বন্ধুদের সাথে মিশুন যারা আপনার সময়ের মূল্য বোঝে এবং আপনাকে ভালো কাজে উৎসাহিত করে।
- ‘না‘ বলতে শিখুন: এমন কোনো আমন্ত্রণ বা অনুরোধ যা আপনার সময়ের অপচয় ঘটাবে এবং আপনার কোনো দুনিয়াবি বা আখিরাতের উপকারে আসবে না, সেটিকে বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করতে শিখুন।
উপসংহার
সময় হলো জীবন। সময়ের সঠিক ব্যবহার করার অর্থ হলো জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানো। ইসলাম আমাদের যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছে, তা শুধু পারলৌকিক মুক্তির জন্যই নয়, বরং একটি সুশৃঙ্খল, উৎপাদনশীল এবং প্রশান্তিময় দুনিয়াবি জীবনযাপনের জন্যও অপরিহার্য।
তাই আসুন, আজ থেকেই এই ৫টি মূলনীতি আমাদের জীবনে প্রয়োগ করি এবং আল্লাহর দেওয়া এই সময়কে আমানত হিসেবে সময়ের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করি।