
পবিত্র কুরআন। এটি শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পাঠানো এক পরিপূর্ণ জীবনবিধান, একটি গাইডবুক। আমরা অনেকেই নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করি, খতমের পর খতম শেষ করি। কিন্তু তেলাওয়াতের সময় আমাদের মনে কি কখনো এই প্রশ্নটি এসেছে: “আল্লাহ আমাকে এখানে কী বলছেন?”
অনেকের ক্ষেত্রেই উত্তরটি হয় ‘না‘। আমরা হয়তো শুধু আরবি পাঠ করেই সাওয়াবের আশা করি, কিন্তু এর ভেতরের অমূল্য বার্তা এবং নির্দেশনাগুলো আমাদের অজানা থেকে যায়। ফলে, কুরআন আমাদের জীবনে সেই গভীর প্রভাব ফেলতে পারে না, যা ফেলা উচিত ছিল।
আপনিও যদি এই সমস্যায় ভুগে থাকেন এবং কুরআনকে গভীরভাবে বুঝতে চান, তাহলে হতাশ হবেন না। নিচে এমন ৫টি কার্যকরী ধাপ নিয়ে আলোচনা করা হলো, যা অনুসরণ করলে ইনশাআল্লাহ আপনার জন্য কুরআন বোঝা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
ধাপ ১: সঠিক নিয়ত এবং পবিত্র অন্তর নিয়ে শুরু করুন
কুরআন বোঝা কোনো সাধারণ বই পড়ার মতো নয়। এটি কোনো অ্যাকাডেমিক পড়াশোনাও নয়। কুরআন বোঝার প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো একটি বিশুদ্ধ নিয়ত এবং গ্রহণের জন্য প্রস্তুত একটি অন্তর।
শুরু করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন:
- আমি কেন কুরআন বুঝতে চাই? মানুষকে দেখানোর জন্য, নাকি আল্লাহর হেদায়েত পাওয়ার জন্য?
- আমার অন্তরে কি কোনো অহংকার, বিদ্বেষ বা দুনিয়াবি আসক্তি আছে যা আমাকে সত্য গ্রহণ করতে বাধা দিতে পারে?
করণীয়:
প্রতিবার কুরআন পড়ার আগে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে অথবা মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন:
“হে আল্লাহ! আমি তোমার বাণী বোঝার জন্য বসছি। তুমি আমার অন্তরকে খুলে দাও, আমার জ্ঞানকে বাড়িয়ে দাও এবং আমাকে এর থেকে হেদায়েত দান করো।“
মনে রাখবেন, কুরআন হলো নূর বা আলো, আর এই আলো কখনো অপবিত্র অন্তরে প্রবেশ করে না।
ধাপ ২: একটি ভালো অনুবাদ এবং সংক্ষিপ্ত তাফসীর নির্বাচন করুন
আমরা যেহেতু আরবি ভাষায় পারদর্শী নই, তাই আমাদের জন্য একটি ভালো মানের অনুবাদ পড়া অপরিহার্য। শুধু শাব্দিক অনুবাদের চেয়ে ভাবানুবাদ অনেক সময় আয়াতের মূল স্পন্দনকে ভালোভাবে তুলে ধরে।
করণীয়:
- সহজবোধ্য অনুবাদ: বাজারে প্রচলিত বেশ কিছু সহজ ও সাবলীল ভাষার অনুবাদ পাওয়া যায়। যেমন—মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের অনুবাদ, তাইসিরুল কুরআন, বা আধুনিক প্রকাশনীগুলোর অনুবাদ। আপনার কাছে যেটির ভাষা সবচেয়ে সহজ মনে হয়, সেটি বেছে নিন।
- সংক্ষিপ্ত তাফসীর: অনুবাদের পাশাপাশি একটি সংক্ষিপ্ত তাফসীর রাখুন। পূর্ণাঙ্গ বিশাল তাফসীর শুরুতে আপনাকে ভারাক্রান্ত করে ফেলতে পারে। তাফসীরে আহসানুল বায়ান বা তাফসীর ইবনে কাসীরের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ দিয়ে শুরু করতে পারেন। যখনই কোনো আয়াতের অর্থ বুঝতে অসুবিধা হবে, সাথে সাথে তাফসীর থেকে তার ব্যাখ্যা দেখে নিন।
ধাপ ৩: অল্প পড়ুন, কিন্তু গভীরভাবে ভাবুন (Quality over Quantity)
আমাদের সবচেয়ে বড় ভুলগুলোর একটি হলো দ্রুতগতিতে অনেক বেশি পড়ার চেষ্টা করা। কুরআন বোঝার জন্য এই অভ্যাসটি পুরোপুরি বিপরীত।
করণীয়:
- প্রতিদিন একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করুন: প্রতিদিন এক পৃষ্ঠা বা এমনকি মাত্র ৫টি আয়াত পড়ার লক্ষ্য নিন।
- থামুন এবং চিন্তা করুন (তাদাব্বুর): প্রতিটি আয়াত পড়ার পর থামুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন:
- এই আয়াতে আল্লাহ আমাকে কী বার্তা দিচ্ছেন?
- এই আয়াতটি আমার জীবনের কোন অংশের সাথে সম্পর্কিত? (যেমন: আমার চরিত্র, আমার পরিবার, আমার কাজ)
- এই আয়াত থেকে আমি আজ কী শিখলাম যা আমি আমার জীবনে প্রয়োগ করতে পারি?
- পুনরাবৃত্তি করুন: একই আয়াত বারবার পড়ুন। দেখবেন, প্রতিবার পড়ার সময় নতুন নতুন অর্থ আপনার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা–ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা দেওয়া আছে?” (সূরা মুহাম্মদ: ২৪)
ধাপ ৪: প্রেক্ষাপট বা শানে নুযূল জানার চেষ্টা করুন
কুরআনের অনেক আয়াত একটি নির্দিষ্ট ঘটনা, প্রশ্ন বা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে। এই প্রেক্ষাপট বা শানে নুযূল জানা থাকলে আয়াতটির প্রকৃত অর্থ এবং এর প্রয়োগ বোঝা অনেক সহজ হয়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ:
সূরা আল–লাহাব কেন আবু লাহাবের বিরুদ্ধে নাযিল হয়েছিল, সেই ঘটনাটি না জানলে আয়াতগুলোর গভীরতা পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
করণীয়:
যখন কোনো আয়াতের অর্থ বা উদ্দেশ্য স্পষ্ট হবে না, তখন আপনার নির্বাচিত সংক্ষিপ্ত তাফসীরে সেই আয়াতের শানে নুযূল বা প্রেক্ষাপট অংশটি পড়ে নিন। এটি আপনার সামনে পুরো চিত্রটি পরিষ্কার করে দেবে।
ধাপ ৫: যা শিখলেন, তা জীবনে প্রয়োগ করুন এবং অন্যদের সাথে আলোচনা করুন
জ্ঞান তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা আমলে পরিণত হয়। কুরআন বোঝার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো এর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
করণীয়:
- আমলের নিয়ত করুন: প্রতিদিন যা শিখবেন, সেখান থেকে অন্তত একটি ছোট বিষয় নিজের জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করুন। যেমন, যদি ধৈর্য নিয়ে কোনো আয়াত পড়েন, তাহলে সেদিন ধৈর্য ধারণের সচেতন অনুশীলন করুন।
- আলোচনা করুন: আপনার পরিবারের সদস্য বা কোনো দ্বীনি বন্ধুর সাথে আপনার শেখা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করুন। জ্ঞান আলোচনা করলে তা আরও ভালোভাবে স্মৃতিতে গেঁথে যায় এবং নতুন দৃষ্টিকোণ উন্মোচিত হয়।
উপসংহার
কুরআন একটি জীবন্ত কিতাব। আপনি যত আন্তরিকতা ও বিনয়ের সাথে এর কাছে যাবেন, কুরআনও তত বেশি তার রহস্য আপনার কাছে উন্মোচন করবে। তাড়াহুড়ো না করে, এই ৫টি ধাপ অনুসরণ করে ধৈর্য সহকারে আপনার যাত্রা চালিয়ে যান।
ইনশাআল্লাহ, খুব শীঘ্রই আপনি দেখবেন, কুরআন আর আপনার কাছে শুধু তেলাওয়াতের গ্রন্থ নয়, বরং এটি আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, আপনার পথপ্রদর্শক এবং আপনার অন্তরের প্রশান্তি হয়ে উঠেছে।