
জীবন মানেই উত্থান-পতন। কখনো আনন্দের ঝিলিক, আবার কখনো কষ্টের গভীর অন্ধকার। এমন সময় আসে যখন চারপাশের সবকিছু অর্থহীন মনে হয়, বুকের ভেতর একটা ভারী পাথর চেপে বসে থাকে, আর একাকিত্বের কালো মেঘ পুরোটা অস্তিত্বকে গ্রাস করে ফেলে। এই অবস্থাকেই আমরা বলি বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন।
এটি শুধু একটি মানসিক অবস্থা নয়, এটি একটি কঠিন পরীক্ষা। এই সময়ে শয়তান আমাদের মনে হতাশা ঢুকিয়ে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করে দিতে চায়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাদের নিরাময়ের পথও বাতলে দিয়েছেন। ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা আমাদের আত্মার গভীরে গিয়ে প্রশান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয়।
আপনি যদি বিষণ্ণতার সাথে লড়াই করে থাকেন, তবে জেনে রাখুন, আপনি একা নন। আর এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার পথও আছে। চলুন, জেনে নিই ইসলামের আলোকে মনকে শান্ত করার সেই ৭টি উপায়।
১. মেনে নিন, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা
জীবনের কঠিন সময়গুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। তিনি দেখতে চান, তাঁর কোন বান্দা বিপদে পড়েও তাঁর উপর ভরসা রাখে। আপনার এই কষ্ট, এই বিষণ্ণতা বৃথা যাচ্ছে না। প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস এবং প্রতিটি ফোঁটা চোখের পানির বিনিময়ে আল্লাহ আপনার গুনাহ মাফ করছেন এবং আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি করছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মুসলিম ব্যক্তির উপর যে ক্লান্তি, রোগ, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট ও পেরেশানি আসে, এমনকি তার দেহে যে কাঁটা বিদ্ধ হয়, এ সবের দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।” (সহিহ বুখারী)
সুতরাং, আপনার কষ্টকে একটি শাস্তি হিসেবে না দেখে, এটিকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করুন।
২. সিজদায় লুটিয়ে পড়ুন: আপনার রবের সবচেয়ে কাছে
যখন মানুষের কাছে নিজের কষ্ট প্রকাশ করা কঠিন হয়ে যায়, তখন এমন একজনের কাছে বলুন যিনি আপনার না বলা কথাগুলোও শোনেন। সিজদা হলো বান্দার সাথে তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হওয়ার মুহূর্ত।
করণীয়:
একটি শান্ত জায়গায় ওযু করে দুই রাকাত নফল নামাজে দাঁড়িয়ে যান। সিজদায় গিয়ে আপনার মনের সব ভার, সব কষ্ট আল্লাহর কাছে অর্পণ করুন। শিশুদের মতো কাঁদুন, অভিযোগ করুন, সাহায্য চান। দেখবেন, সিজদা থেকে ওঠার পর আপনার মনটা কতটা হালকা হয়ে গেছে। কারণ আপনি আপনার সব ভার পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সত্তার কাছে জমা দিয়েছেন।
৩. কুরআনকে বানান আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু
কুরআন শুধু তিলাওয়াতের জন্য একটি গ্রন্থ নয়, এটি হলো “শিফা” বা নিরাময়। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
“আর আমি কুরআন নাজিল করি যা মুমিনদের জন্য শিফা (নিরাময়) ও রহমত।” (সূরা আল-ইসরা: ৮২)
করণীয়:
- অর্থসহ পড়ুন: প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় বের করে অর্থসহ কুরআন পড়ুন। বিশেষ করে সূরা আর-রহমান, সূরা আদ-দুহা এবং সূরা আল-ইনশিরাহ পড়ুন। সূরা আদ-দুহা আল্লাহ তাঁর নবীকে (সাঃ) বিষণ্ণতার সময় সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নাজিল করেছিলেন।
- মনোযোগ দিয়ে শুনুন: যখন পড়তে ইচ্ছে করবে না, তখন কোনো প্রিয় ক্বারীর কণ্ঠে শান্তভাবে কুরআন তিলাওয়াত শুনুন। কুরআনের সুর আপনার অস্থির আত্মাকে শান্ত করবে।
৪. শোকর বা কৃতজ্ঞতার চর্চা করুন
বিষণ্ণতা আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিয়ে শুধু যা ‘নেই’ তার উপর নিবদ্ধ করে। কৃতজ্ঞতার চর্চা এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। এটি আমাদের শেখায়, যা ‘আছে’ তার দিকে তাকাতে।
করণীয়:
একটি ডায়েরি নিন, যার নাম দিন “শোকর ডায়েরি”। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে আল্লাহর দেওয়া অন্তত তিনটি ছোট ছোট নিয়ামতের কথা লিখুন, যার জন্য আপনি কৃতজ্ঞ। হতে পারে সেটা এক কাপ গরম চা, আপনার সুস্থ দুটি চোখ, অথবা পরিবারের কারো মুখের হাসি। এই ছোট অভ্যাসটি আপনার মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে ইতিবাচকতার দিকে নিয়ে যাবে।
৫. জিকির ও দোয়ায় জিহ্বাকে সিক্ত রাখুন
অবিরাম নেতিবাচক চিন্তা বিষণ্ণতার অন্যতম প্রধান কারণ। এই চিন্তার চক্র ভাঙার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো জিহ্বাকে আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত রাখা।
কিছু শক্তিশালী জিকির ও দোয়া:
- “লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন” (দোয়া ইউনুস): গভীর সংকট ও অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য এটি এক অব্যর্থ দোয়া।
- “লা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”: যখন নিজেকে খুব অসহায় এবং শক্তিহীন মনে হবে, তখন এই জিকিরটি পাঠ করুন।
- ইস্তেগফার (আস্তাগফিরুল্লাহ): এটি মনের বোঝা হালকা করে এবং রহমতের দরজা খুলে দেয়।
৬. প্রকৃতির মাঝে সময় কাটান
আকাশ, গাছপালা, নদী, পাখি—এগুলো আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন। প্রকৃতির মাঝে কিছুক্ষণ সময় কাটালে তা মনকে সতেজ করে এবং আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই বিশাল মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন, যিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রকৃতির নির্মলতা আমাদের ভেতরের অস্থিরতাকে শান্ত করতে সাহায্য করে।
৭. অন্যের জন্য কিছু করুন
বিষণ্ণতা আমাদের আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। এই চক্র থেকে বের হওয়ার একটি সুন্দর উপায় হলো অন্যের উপকারে আসা। যখন আপনি নিজের কষ্ট ভুলে অন্য কোনো দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করবেন, তখন আল্লাহ আপনার মুখে হাসি ফোটানোর ব্যবস্থা করে দেবেন। হতে পারে কোনো অভাবীকে সামান্য কিছু দান করা বা শুধু কারো কষ্টের কথা মন দিয়ে শোনা।
উপসংহার
বিষণ্ণতা একটি বাস্তব এবং কঠিন লড়াই। এর জন্য প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য (কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা) নেওয়াও ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ এবং জরুরি। তবে, চিকিৎসার পাশাপাশি এই আধ্যাত্মিক উপায়গুলো আপনার আত্মাকে ভেতর থেকে শক্তিশালী করবে।
হতাশ হবেন না। মনে রাখবেন, প্রতিটি রাতের পরেই একটি ভোর থাকে। আপনার এই কঠিন সময়টাও কেটে যাবে। আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখুন, কারণ তিনি वादा করেছেন: “সুতরাং, কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে।” (সূরা আশ-শারহ: ৫)