
ইসলামের যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আধুনিক সমাজে সবচেয়ে বেশি আলোচনা, সমালোচনা এবং ভুল বোঝাবুঝি হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো বহুবিবাহ (Polygyny)। এই বিষয়টি সামনে এলেই আমাদের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। এটি কি পুরুষের জন্য একটি অবাধ অধিকার? এর পেছনের উদ্দেশ্য কী? এবং বর্তমান সময়ে এর প্রয়োগ কতটা বাস্তবসম্মত?
এই আর্টিকেলে আমরা কোনো বিতর্কে না গিয়ে, বরং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব এবং সব পক্ষের জন্য কিছু জরুরি নসিহাহ তুলে ধরব।
বিশ্লেষণ: বহুবিবাহের অনুমতি ও তার প্রেক্ষাপট
প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে, ইসলাম বহুবিবাহ প্রথার উদ্ভাবক নয়। বরং ইসলাম একটি বিদ্যমান প্রথাকে অত্যন্ত কঠোর শর্তের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রিত করেছে। প্রাক–ইসলামি যুগে একজন পুরুষ যতজন ইচ্ছা নারীকে বিয়ে করতে পারত, তাদের কোনো অধিকার বা মর্যাদার নিশ্চয়তা ছিল না।
ইসলাম এসে এই লাগামহীন প্রথাকে নিয়ন্ত্রণ করে সর্বোচ্চ চারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে এবং এর সাথে জুড়ে দেয় এক কঠিন শর্ত—عدل (আদল) বা সুবিচার।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“আর যদি তোমরা আশঙ্কা করো যে, এতিমদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে নারীদের মধ্য থেকে তোমাদের যাকে ভালো লাগে, তাকে বিয়ে করতে পারো—দুই, তিন অথবা চারজন। কিন্তু যদি তোমরা আশঙ্কা করো যে, তোমরা সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে (বিয়ে করো)।“ (সূরা আন–নিসা: ৩)
এই আয়াত থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট:
- এটি একটি শর্তযুক্ত অনুমতি, সাধারণ সুপারিশ নয়: আয়াতের মূল ফোকাস ছিল সেই সময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজে এতিম ও বিধবাদের সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা প্রদান করা। বহুবিবাহ ছিল এর একটি সমাধান, সাধারণ নিয়ম নয়।
- মূল শর্ত হলো সুবিচার: এই অনুমতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘আদল‘ বা সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার সক্ষমতা। যদি সুবিচারের বিন্দুমাত্র আশঙ্কা থাকে, তবে ইসলাম স্পষ্টভাবে একজনকে বিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছে।
সুবিচার বা ‘আদল‘-এর অর্থ কী?
ইসলামে সুবিচারের ধারণাটি অত্যন্ত ব্যাপক। বহুবিবাহের ক্ষেত্রে এটি মূলত দুটি জিনিসের নিশ্চয়তা দেয়:
- আর্থিক ও বস্তুগত সমতা: সকল স্ত্রীর জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সমতার ভিত্তিতে প্রদান করা। একজনের জন্য বিলাসবহুল ব্যবস্থা আর অন্যজনের জন্য সাধারণ ব্যবস্থা—এটি সুস্পষ্ট অবিচার।
- সময় ও সাহচর্যের সমতা: স্ত্রীদের সাথে সময় কাটানো, বিশেষ করে রাত্রিযাপনের ক্ষেত্রে সমবণ্টন করা। কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়ে অন্যজনকে উপেক্ষা করা বা ঝুলিয়ে রাখা কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যার দুজন স্ত্রী আছে, কিন্তু সে তাদের একজনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, কিয়ামতের দিন সে তার শরীরের অর্ধেক অংশ অবশ অবস্থায় উপস্থিত হবে।“ (সুনানে আবু দাউদ)
তবে, আল্লাহ তা‘আলা এও জানেন যে, মানুষের পক্ষে অন্তরের ভালোবাসা বা মানসিক আকর্ষণ সমান রাখা সম্ভব নয়। তাই তিনি বলেন:
“আর তোমরা যতই ইচ্ছা করো না কেন, তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি সমানভাবে আকৃষ্ট হতে কখনো পারবে না।“ (সূরা আন–নিসা: ১২৯)
এর অর্থ হলো, অন্তরের টান কমবেশি হতে পারে, কিন্তু বাহ্যিক আচরণ, ভরণপোষণ এবং সময় বণ্টনের ক্ষেত্রে সুবিচার করা ফরজ।
কিছু জরুরি নসিহাহ (Practical Advice)
বিষয়টি যেহেতু একটি বিশাল দায়িত্ব ও আমানত, তাই এর সাথে জড়িত সব পক্ষের জন্য কিছু নসিহাহ অত্যন্ত জরুরি।
১. যে পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবছেন:
- নিয়তকে পরিশুদ্ধ করুন: নিজেকে প্রশ্ন করুন, কেন আপনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চান? আপনার উদ্দেশ্য কি কোনো বিধবা বা অসহায় নারীকে আশ্রয় দেওয়া, কোনো বিশেষ সামাজিক প্রয়োজন পূরণ করা, নাকি নিছকই কামনা–বাসনা বা প্রথম স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্টি? আপনার নিয়ত যদি সৎ না হয়, তবে এই সম্পর্ক কখনোই বরকতময় হবে না।
- আত্ম–নিরীক্ষা করুন: আপনার কি বস্তুগত, শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা আছে? আপনি কি দুইজন (বা ততোধিক) পরিবারের ভরণপোষণের চাপ নিতে পারবেন? আপনি কি সময়ের বণ্টনে সুবিচার করতে পারবেন বলে শতভাগ আত্মবিশ্বাসী? যদি সামান্যতম সন্দেহ থাকে, তবে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী এক স্ত্রী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুন।
- প্রথম স্ত্রীর সাথে আলোচনা: এটি তার জন্য একটি অত্যন্ত কঠিন মানসিক পরীক্ষা। বিষয়টি গোপন না করে, অত্যন্ত হিকমত, সম্মান এবং সহানুভূতির সাথে তার সাথে আলোচনা করুন। তার অনুভূতিকে গুরুত্ব দিন। তাকে তার অধিকার সম্পর্কে আশ্বস্ত করুন।
২. প্রথম স্ত্রীর জন্য নসিহাহ:
- ধৈর্য ও আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা: নিঃসন্দেহে এটি একজন নারীর জন্য সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলোর একটি। এই পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করুন এবং আল্লাহর কাছে মানসিক শক্তি ও প্রশান্তির জন্য দোয়া করুন।
- নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোন: ইসলাম আপনাকে যে অধিকার (ভরণপোষণ ও সময়ের সমতা) দিয়েছে, সে ব্যাপারে সচেতন থাকুন। আপনার প্রতি কোনো অবিচার হলে তা নিয়ে সুন্দরভাবে কথা বলুন।
- ধ্বংসাত্মক আচরণ থেকে বিরত থাকুন: রাগ, ক্ষোভ বা ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে এমন কোনো কাজ করবেন না, যা আপনার নিজের এবং পরিবারের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর।
৩. দ্বিতীয় স্ত্রীর জন্য নসিহাহ:
- বাস্তবতা মেনে নিন: আপনি একটি বিদ্যমান পরিবারে প্রবেশ করছেন। পরিস্থিতি সবসময় সহজ হবে না। আপনাকে অনেক ধৈর্যশীল এবং সহনশীল হতে হবে।
- অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করবেন না: প্রথম স্ত্রীর অধিকারে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকুন। স্বামীর কাছে তার ব্যাপারে অন্যায় কোনো দাবি বা অভিযোগ করবেন না।
উপসংহার
বহুবিবাহ ইসলামে নিছক ভোগবিলাসের জন্য প্রদত্ত কোনো অধিকার নয়, বরং এটি একটি বিশাল দায়িত্ব যা কঠোর শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ। এটি একটি ব্যতিক্রমী অনুমতি যা বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রয়োগযোগ্য। এর মূল ভিত্তি হলো তাকওয়া (আল্লাহভীতি) এবং সুবিচার।
যে ব্যক্তি সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, তার জন্য একাধিক বিয়ে জাহান্নামের পথকে সুগম করতে পারে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন মেনে, সুবিচারের সাথে এই দায়িত্ব পালন করবে, তার জন্য হয়তো এতে কল্যাণ নিহিত থাকতে পারে। দিনশেষে, প্রতিটি কাজের জন্য আমাদের সবাইকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে এবং প্রতিটি অধিকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।