
আমরা সবাই জীবনে সফল হতে চাই। ভালো ছাত্র, দক্ষ কর্মী বা একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু আমাদের এই স্বপ্নের পথে সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর একটি হলো অলসতা। অনেক সময় দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামনে থাকা সত্ত্বেও আমরা শুরু করতে পারছি না, মনোযোগ হারিয়ে ফেলছি, আর বারবার কাজ পিছিয়ে দিচ্ছি (Procrastination)।
এই সমস্যাটি শুধু আজকের নয়। চৌদ্দশ বছর আগেও মানুষ এই সমস্যায় ভুগত। আর তাই আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আমাদের এমন কিছু অসাধারণ কৌশল ও দোয়া শিখিয়ে গেছেন, যা অলসতার শিকল ভেঙে আমাদের জীবনে গতি এবং বরকত ফিরিয়ে আনতে পারে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই ৪টি শক্তিশালী নববী কৌশল…………………
১. আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা (সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার)
অলসতা কেবল একটি সাধারণ অভ্যাস নয়, এটি অনেক সময় শয়তানের ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণার ফলও হতে পারে। শয়তান চায় আমরা যেন ভালো কাজ থেকে বিরত থাকি এবং আমাদের সময়গুলো অহেতুক নষ্ট করি। তাই এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হলো সরাসরি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে একটি দোয়া নিয়মিত পড়তেন এবং তাঁর সাহাবীদেরও পড়তে উৎসাহিত করতেন।
আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) প্রায়ই এই দোয়াটি করতেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আ‘উযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযান, ওয়াল ‘আজযি ওয়াল কাসাল, ওয়াল বুখলি ওয়াল জুবন, ওয়া দালা‘ইদ দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের বোঝা ও মানুষের প্রাধান্য থেকে।” (সহিহ বুখারী)
করণীয়:
প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায়, বিশেষ করে ফজরের নামাজের পর এই দোয়াটি পাঠ করার অভ্যাস করুন। যখনই কাজ করতে গিয়ে অলসতা অনুভব করবেন, তখনই এই দোয়াটি পড়ুন। এটি আপনার মনোবলকে শক্তিশালী করবে এবং শয়তানের প্রভাব থেকে আপনাকে রক্ষা করবে।
২. সকালের সময়ের সঠিক ব্যবহার (বরকতের সময়কে কাজে লাগানো)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর উম্মতের জন্য ভোরের সময়ে বরকতের দোয়া করেছেন। তিনি বলেছেন:
“হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য তার সকালের সময়ে বরকত দান করুন।“ (সুনানে তিরমিযি)
সকালের প্রথম প্রহর, বিশেষ করে ফজরের পরের সময়টুকু হলো দিনের সবচেয়ে প্রোডাক্টিভ এবং বরকতময় সময়। এই সময়ে মস্তিষ্ক সবচেয়ে সতেজ থাকে এবং পরিবেশ থাকে শান্ত।
করণীয়:
- তাড়াতাড়ি ঘুমানো, তাড়াতাড়ি ওঠা: এশার নামাজের পর অপ্রয়োজনীয় কাজ বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন। এতে ফজরের সময় ওঠা আপনার জন্য সহজ হবে।
- ফজরের পর না ঘুমানো: ফজরের নামাজ আদায় করে সাথে সাথে না ঘুমিয়ে কিছু সময়ের জন্য কুরআন তেলাওয়াত করুন, জিকির করুন অথবা আপনার দিনের সবচেয়ে কঠিন বা গুরুত্বপূর্ণ কাজটি শুরু করে দিন।
- দিনের পরিকল্পনা করা: এই শান্ত সময়ে ৫–১০ মিনিট ব্যয় করে সারাদিনের কাজের একটি তালিকা বা পরিকল্পনা তৈরি করুন।
এই অভ্যাসটি আপনার সারাদিনের কাজে একটি ইতিবাচক গতি এনে দেবে এবং অলসতাকে শুরুতেই পরাজিত করবে।
৩. কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা
অনেক সময় বড় কোনো কাজ দেখলে আমরা শুরু করার সাহস হারিয়ে ফেলি এবং অলসতা করি। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়, ছোট কিন্তু ধারাবাহিক আমল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল কোনটি?’ তিনি বলেন, ‘যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়।’ (সহিহ বুখারী)
এই নীতিটি আমাদের দুনিয়াবি কাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
করণীয়:
- কাজকে ভাঙুন: একটি বড় কাজকে (যেমন: একটি পরীক্ষার প্রস্তুতি) কয়েকটি ছোট ছোট, সহজ ধাপে ভাগ করে নিন (যেমন: অধ্যায় ১ পড়া, নোট তৈরি করা, প্রশ্ন সমাধান করা)।
- একটি ধাপ দিয়ে শুরু করুন: শুধুমাত্র প্রথম ছোট ধাপটি শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করুন। এটি শেষ হলে আপনি কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা পাবেন।
- নিয়মিত করুন: প্রতিদিন অল্প অল্প করে কাজ করার অভ্যাস করুন। এক দিনে ১০ ঘণ্টা পড়ার চেয়ে প্রতিদিন নিয়মিত ২ ঘণ্টা পড়া অনেক বেশি কার্যকর।
৪. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও পরিমিত আহার
শারীরিক সুস্থতার সাথে মানসিক শক্তি ও কর্মস্পৃহার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ইসলাম আমাদের একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। অতিরিক্ত আহার অলসতা এবং ঘুম ঘুম ভাবের অন্যতম প্রধান কারণ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “আদম সন্তান তার পেটের চেয়ে মন্দ কোনো পাত্র পূরণ করে না। আদম সন্তানের জন্য কয়েক লোকমা খাবারই যথেষ্ট, যা তার কোমরকে সোজা রাখতে পারে। আর যদি এর চেয়ে বেশি খেতেই হয়, তবে পেটের এক–তৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, এক–তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং এক–তৃতীয়াংশ শ্বাস–প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে।“ (সুনানে তিরমিযি)
করণীয়:
- পরিমিত আহার: পেট ভরে না খেয়ে কিছুটা ক্ষুধা রেখে খাওয়া শেষ করুন।
- স্বাস্থ্যকর খাবার: প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর খাবার (ফল, সবজি) গ্রহণ করুন।
- কায়িক পরিশ্রম: দিনে কিছুটা সময় হাঁটাচলা বা হালকা ব্যায়াম করুন। এটি শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং মস্তিষ্ককে সতেজ রাখে।
উপসংহার
অলসতা একটি নীরব শত্রু যা আমাদের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য এবং রাসূল (সাঃ)-এর দেখানো পথে চলে আমরা এই শত্রুকে পরাজিত করতে পারি।আসুন, আজ থেকেই এই নববী কৌশলগুলো আমাদের জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করি—আল্লাহর কাছে দোয়া করি, সকালের বরকতময় সময়কে কাজে লাগাই, কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করি এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করি। ইনশাআল্লাহ, আমাদের জীবন থেকে অলসতা দূর হবে এবং প্রতিটি কাজে আমরা মনোযোগ ও বরকত খুঁজে পাব।