ভূমিকা
জীবন একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। মহান আল্লাহ তা’আলা কখনো সুখ দিয়ে, আবার কখনো দুঃখ, বিপদ-আপদ, অসুস্থতা বা আর্থিক সংকট দিয়ে আমাদের পরীক্ষা করেন। একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো, সে বিপদে ভেঙে পড়ে না, হতাশ হয় না। বরং, সে ধৈর্য ধারণ করে এবং সবকিছুর জন্য এক আল্লাহর উপর ভরসা করে, তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। কারণ তিনিই একমাত্র উদ্ধারকারী।
বিপদ থেকে মুক্তির দোয়া এই আর্টিকেলে আমরা এমন কিছু পরীক্ষিত ও শক্তিশালী দোয়া ও আমল সম্পর্কে জানব, যা সরাসরি কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই আমলগুলো যেকোনো বিপদ, দুশ্চিন্তা ও পেরেশানিতে একজন মুমিনের জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে এবং আল্লাহর সাহায্যকে ত্বরান্বিত করবে, ইনশাআল্লাহ।
বিপদ কেন আসে? ইসলামের দৃষ্টিকোণ
বিপদকে শাস্তি মনে করে হতাশ হওয়ার আগে, আসুন জেনে নিই ইসলাম এ বিষয়ে কী বলে। বিপদ আসার পেছনে একাধিক মহৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
১. আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা হিসেবে
আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা করেন তাদের ঈমানের দৃঢ়তা যাচাই করার জন্য। তিনি বলেন:
“এবং আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদেরকে।” (সূরা আল-বাকারাহ: ১৫৫)
২. গুনাহের কাফফারা বা ক্ষমা হিসেবে
দুনিয়ার ছোট ছোট বিপদ-আপদ আখিরাতের কঠিন শাস্তির তুলনায় কিছুই নয়। অনেক সময় আল্লাহ দুনিয়াতে ছোট বিপদ দিয়ে বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন, যাতে সে আখিরাতে پاک (পাক) হয়ে উঠতে পারে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “মুমিনের উপর যে কোনো কষ্ট, রোগ, চিন্তা, দুঃখ, এমনকি ( শরীরে ) কাঁটা বিঁধলেও, আল্লাহ তার বিনিময়ে তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেন।” (সহীহ বুখারী)
৩. বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য
কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তাকে নিজের আরও নিকটবর্তী করে নেন। নবী-রাসূলগণ সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন, কারণ তাঁরাই ছিলেন আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়।
বিপদের মুহূর্তে একজন মুমিনের সেরা দুটি হাতিয়ার
বিপদের উত্তাল সমুদ্রে যখন সবকিছু অন্ধকার মনে হয়, তখন দুটি জিনিস মুমিনের জন্য লাইফ-জ্যাকেটের মতো কাজ করে।
- সবর (ধৈর্য)
বিপদে অধৈর্য না হয়ে আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকাই হলো সবর। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের অপরিসীম পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “…ধৈর্যশীলদেরকে তো তাদের পুরস্কার বিনা হিসাবেই দেওয়া হবে।” (সূরা আয-যুমার: ১০)
- সালাত (নামাজ)
আল্লাহর সাথে কথা বলার এবং তাঁর কাছে সরাসরি সাহায্য চাওয়ার সর্বোত্তম মাধ্যম হলো সালাত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখনই কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতেন, তিনি সাথে সাথে সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।” (সূরা আল-বাকারাহ: ১৫৩)
বিপদ থেকে মুক্তির ১০টি পরীক্ষিত দোয়া ও আমল (কুরআন ও সুন্নাহ থেকে)
১. দোয়া ইউনুস: সংকটের গভীরে আল্লাহর আশ্রয়
এটি বিপদ থেকে মুক্তির জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী এবং পরীক্ষিত দোয়াগুলোর একটি। হযরত ইউনুস (আঃ) যখন মাছের পেটের গভীর অন্ধকারে বন্দি ছিলেন, তখন তিনি এই দোয়া পাঠ করেছিলেন।
لَّآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنتَ سُبْحَٰنَكَ إِنِّى كُنتُ مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ
উচ্চারণ: লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুবহা-নাকা ইন্নী কুনতু মিনায্ যোয়া-লিমীন।
অর্থ: “(হে আল্লাহ) আপনি ছাড়া কোনো истинный ইলাহ নেই, আপনি পবিত্র। নিশ্চয়ই আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম।”
ফজিলত: রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “যেকোনো মুসলিম ব্যক্তি যেকোনো বিপদে পড়ে এই দোয়া পাঠ করবে, আল্লাহ অবশ্যই তার দোয়া কবুল করবেন।” (তিরমিযী)
২. ইস্তেগফার: গুনাহ মাফ ও বিপদ মুক্তির দরজা
বিপদ আসার অন্যতম কারণ হলো আমাদের গুনাহ। তাই বেশি বেশি ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ বিপদ তুলে নেন।
أَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহ।
অর্থ: “আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
ফজিলত: রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে, আল্লাহ তাকে সকল বিপদ থেকে মুক্তির পথ করে দেবেন, সকল দুশ্চিন্তা থেকে তাকে মুক্ত করবেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দান করবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না।” (আবু দাউদ)
৩. দুশ্চিন্তা ও পেরেশানির দোয়া: নবীজির (ﷺ) শেখানো বিশেষ আমল
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে যখন কোনো দুশ্চিন্তা বা পেরেশানিতে পড়তেন, তখন এই দোয়াটি বেশি বেশি পাঠ করতেন।
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ… (সম্পূর্ণ দোয়া হাদীস থেকে দেখে নেওয়া উত্তম)
অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কাপুরুষতা ও কৃপণতা থেকে এবং ঋণের বোঝা ও মানুষের প্রাবল্য (চাপ) থেকে।” (বুখারী)
৪. “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পাঠ করা
যেকোনো দুঃসংবাদ, মৃত্যু বা বিপদের খবর শোনার সাথে সাথে এই বাক্যটি পাঠ করা সুন্নাহ।
إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ
অর্থ: “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাব।”
ফজিলত: যে ব্যক্তি বিপদে পড়ে এই দোয়া পাঠ করে, আল্লাহ তাকে এর চেয়েও উত্তম প্রতিদান দেন এবং তার জন্য বিপদকে কল্যাণে রূপান্তরিত করে দেন। (মুসলিম)
৫. দরুদ শরীফ: রহমতের চাবি
রাসূল (ﷺ)-এর উপর দরুদ পাঠ করা আল্লাহর রহমত লাভের অন্যতম সেরা উপায়।
ফজিলত: উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) যখন বললেন যে, তিনি তাঁর দোয়ার সম্পূর্ণ অংশই দরুদের জন্য বরাদ্দ করবেন, তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, “তাহলে তো তোমার সকল চিন্তা-পেরেশানির জন্য এটাই যথেষ্ট হয়ে যাবে এবং তোমার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (তিরমিযী)
৬. “হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকীল”: আল্লাহর উপর চূড়ান্ত ভরসা
এটি তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ প্রকাশ। যখন সব দরজা বন্ধ মনে হয়, তখন এই দোয়াটি পাঠ করুন।
حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ
অর্থ: “আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক।”
ফজিলত: হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছিল, তখন তিনি এটি পাঠ করেছিলেন, ফলে আগুন তাঁর জন্য শান্তিদায়ক হয়ে গিয়েছিল।
৭. সাদকা: বিপদ দূরকারী মহৌষধ
বিপদে পড়লে গোপনে বা প্রকাশ্যে কিছু দান-সাদকা করুন।
ফজিলত: রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “সাদকা বালা-মুসিবত দূর করে এবং হায়াত (জীবন) বৃদ্ধি করে।” (শু’আবুল ঈমান)
৮. “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”: আল্লাহর শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ
যখন কোনো কাজ কঠিন মনে হয় বা কোনো বিপদ থেকে উদ্ধারের উপায় দেখা যায় না, তখন এই জিকিরটি পাঠ করুন।
لا حَوْلَ وَلا قُوَّةَ إِلا بِالله
অর্থ: “আল্লাহর সাহায্য ছাড়া গুনাহ থেকে বাঁচার এবং সৎকাজ করার কোনো শক্তি নেই।”
ফজিলত: এটিকে রাসূল (ﷺ) “জান্নাতের অন্যতম গুপ্তধন” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
৯. আয়াতুল কুরসি: সুরক্ষার ঐশ্বরিক দুর্গ
এটি জিন, শয়তান এবং সকল প্রকার মানবীয় ও অমানবীয় ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য একটি শক্তিশালী দুর্গ।
১০. সূরা ফালাক ও নাস: সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে আশ্রয়
জাদু, বদনজর এবং সকল প্রকার গোপনীয় বিপদ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার সেরা মাধ্যম।
এক নজরে বিপদ মুক্তির দোয়া
দোয়ার নাম |
কখন পড়বেন |
প্রধান উপকারিতা |
দোয়া ইউনুস | যেকোনো কঠিন বিপদ বা গভীর সংকটে। | দোয়া দ্রুত কবুল হয়, বিপদ কেটে যায়। |
ইস্তেগফার | সার্বক্ষণিক, বিশেষ করে কোনো ভুল হয়ে গেলে। | দুশ্চিন্তা দূর হয়, রিজিক ও রহমতের দরজা খুলে যায়। |
দরুদ শরীফ | সার্বক্ষণিক, বিশেষ করে জুমার দিনে। | সকল পেরেশানি দূর হয়, গুনাহ মাফ হয়। |
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
প্রশ্ন: দুনিয়াবী বিপদ থেকে বাঁচার জন্য কি শিরকি তাবিজ-কবচ ব্যবহার করা যাবে?
উত্তর: কক্ষনোই না। তাবিজ-কবচ ব্যবহার করা, যা কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়, তা শিরকের অন্তর্ভুক্ত এবং সবচেয়ে বড় গুনাহ। বিপদ থেকে মুক্তির জন্য শুধুমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে এবং তাঁর শেখানো পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হবে।
প্রশ্ন: অসুস্থতাও কি এক ধরনের বিপদ? এর জন্য কী দোয়া করব?
উত্তর: হ্যাঁ, অসুস্থতা একটি বড় পরীক্ষা ও বিপদ। এর জন্য উপরে উল্লিখিত সকল দোয়ার পাশাপাশি অসুস্থতা থেকে আরোগ্যের জন্য মাসনূন দোয়াগুলো পাঠ করা উচিত।
উপসংহার: বিপদ থেকে মুক্তির দোয়া
বিপদ মুমিনের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বার্তা—ফিরে এসো, আমাকে ডাকো, আমার কাছেই সাহায্য চাও। তাই বিপদে অধৈর্য না হয়ে, সবর, সালাত এবং এই শক্তিশালী দোয়াগুলোকে আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী বানাই। বিশ্বাস রাখুন, যে আল্লাহ রাতের পর দিন আনেন, তিনি আপনার বিপদের পর অবশ্যই সুখ ও শান্তি দান করবেন।
আরোও পড়ুন…….
-
- ১০টি জীবন বদলে দেওয়া দোয়া যা প্রতিটি ব্যক্তির জানা উচিত
- সময় নষ্ট করছেন? ইসলামে সময় ব্যবস্থাপনার সেরা ৫টি মূলনীতি
- বিষণ্ণতা যখন ঘিরে ধরে : ইসলামের আলোকে মনকে শান্ত করার ৭ টি অসাধারণ উপায়
- দোয়া কবুল হওয়ার আমল: জেনে নিন সহজ ও গোপন রহস্য
- ভয়াবহ কালো জাদু থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় – দোয়া, লক্ষণ ও মুক্তির পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা
🕋 আমাদের পছন্দের কিছু ইসলামিক পণ্য
এই লিঙ্কগুলো থেকে কেনাকাটা করলে সাইটটির সাপোর্ট হয়, আপনার কোনো অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই। জাযাকাল্লাহু খাইরান।
- সুন্দর এবং আরামদায়ক জায়নামাজ: এখানে দেখুন
- খাঁটি এবং অ্যালকোহল-মুক্ত আতর: এখানে দেখুন
- মানসম্মত টুপি/টুপি সেট: এখানে দেখুন
- ডিজিটাল তাসবীহ/গণনা যন্ত্র: এখানে দেখুন