দরুদ শরীফ পড়ার নিয়ম ও ফজিলত: যে একটি আমলে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল চিন্তা দূর হয়

ভূমিকা
ঈমানের স্বাদ কেমন? এর মিষ্টতা কোথায় লুকিয়ে আছে? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিখিয়েছেন, ঈমানের স্বাদ সেই পাবে, যার কাছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল অন্য সবকিছুর চেয়ে প্রিয় হয়ে যাবে। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায় তাঁর ইবাদতের মাধ্যমে, আর তাঁর প্রিয় হাবীব, মুহাম্মদ (ﷺ)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের সবচেয়ে সুন্দর, সহজ এবং শক্তিশালী মাধ্যম হলো দরুদ শরীফ পাঠ করা।

দরুদ শুধু কিছু আরবি শব্দের সমষ্টি নয়; এটি আপনার পক্ষ থেকে আপনার প্রিয় নবীর (ﷺ) জন্য পাঠানো এক টুকরো ভালোবাসা, একরাশ দোয়া এবং অশেষ শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। এটি এমন এক শক্তিশালী আমল, যার কথা আল্লাহ নিজে কুরআনে বলেছেন এবং যা আপনার জীবনের সকল দুশ্চিন্তা, পেরেশানি এবং বিপদ-আপদ দূর করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই প্রবন্ধে আমরা জানব দরুদ শরীফের অবিশ্বাস্য ফজিলত, এর সঠিক নিয়ম এবং কীভাবে এই একটি সহজ আমল আপনার দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণের দরজা খুলে দিতে পারে।

দরুদ শরীফ কী এবং কেন পাঠ করব? কুরআনের সরাসরি নির্দেশ

“দরুদ” একটি ফারসি শব্দ, যার অর্থ প্রার্থনা বা দোয়া। আরবিতে একে “সালাত ‘আলান নবী” (ٱلصَّلَاةُ عَلَى ٱلنَّبِيِّ) বলা হয়। পারিভাষিকভাবে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষণের জন্য দোয়া করাই হলো দরুদ শরীফ।

এই আমলটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, আল্লাহ তা’আলা নিজে এবং তাঁর ফেরেশতাগণও তা পালন করেন এবং মুমিনদেরকেও তা করার জন্য সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন:

“নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর উপর সালাত (দরুদ) প্রেরণ করেন। হে ঈমানদারগণ, তোমরাও তাঁর উপর সালাত (দরুদ) পাঠাও এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।” (সূরা আল-আহযাব: ৫৬)

সুবহানাল্লাহ! এমন আর কোনো ইবাদত আছে কি, যা আল্লাহ নিজে করেন এবং আমাদেরকেও করার নির্দেশ দেন?

দরুদ শরীফের ১০টি অবিশ্বাস্য ফজিলত (সহীহ হাদীসের আলোকে)

দরুদ শরীফের ফজিলত অগণিত। নিচে সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণিত ১০টি প্রধান ফজিলত তুলে ধরা হলো।

১. আল্লাহর পক্ষ থেকে ১০টি রহমত:
রাসূল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত বর্ষণ করবেন।” (সহীহ মুসলিম)

২. ১০টি গুনাহ মাফ এবং ১০টি মর্যাদা বৃদ্ধি:
রাসূল (ﷺ) আরও বলেন, “…তার দশটি গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে এবং তার মর্যাদা দশগুণ বৃদ্ধি করা হবে।” (সুনানে নাসায়ী, সহীহ)

৩. দোয়া কবুলের অন্যতম প্রধান শর্ত:
উমার (রাঃ) বলেন, “নিশ্চয়ই দোয়া আসমান ও জমিনের মাঝখানে থেমে থাকে, উপরে ওঠে না, যতক্ষণ না তুমি তোমার নবীর উপর দরুদ পাঠ করো।” (তিরমিযী) দোয়ার শুরুতে এবং শেষে দরুদ পাঠ করলে, মাঝের দোয়া আল্লাহ ফেরত দেন না।

৪. সকল দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির কারণ:
সাহাবী উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) যখন রাসূল (ﷺ)-কে বললেন যে, তিনি তাঁর দোয়ার সম্পূর্ণ সময়টিই দরুদের জন্য বরাদ্দ করবেন, তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, “তাহলে তো তোমার সকল চিন্তা-পেরেশানির জন্য এটাই যথেষ্ট হয়ে যাবে এবং তোমার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (তিরমিযী, হাসান)

৫. কিয়ামতের দিন রাসূল (ﷺ)-এর শাফায়াত ও নৈকট্য লাভ:
রাসূল (ﷺ) বলেন, “কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে সেই ব্যক্তি, যে আমার উপর সবচেয়ে বেশি দরুদ পাঠ করেছে।” (তিরমিযী)

৬. দারিদ্র্যতা দূর হয় এবং প্রয়োজন পূরণ হয়।

৭. রাসূল (ﷺ)-এর কাছে সরাসরি সালাম পৌঁছানো হয়:
রাসূল (ﷺ) বলেন, “পৃথিবীতে আল্লাহর একদল বিচরণকারী ফেরেশতা রয়েছেন, যারা আমার উম্মতের পক্ষ থেকে আমার কাছে সালাম পৌঁছে দেন।” (সুনানে নাসায়ী)

৮. কৃপণতা থেকে মুক্তি:
রাসূল (ﷺ) বলেন, “প্রকৃত কৃপণ তো সেই ব্যক্তি, যার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হলো, কিন্তু সে আমার উপর দরুদ পাঠ করল না।” (তিরমিযী)

৯. আল্লাহর স্মরণের অংশ:
দরুদ পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশেরই আনুগত্য করা হয়, যা এক প্রকার জিকির।

১০. রহমতের মজলিস:
যে বৈঠকে বা মজলিসে আল্লাহর জিকির এবং তাঁর রাসূলের (ﷺ) উপর দরুদ পাঠ করা হয়, তা রহমত এবং বরকতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

দরুদ শরীফ পড়ার নিয়ম

দরুদ শরীফ পড়ার নিয়ম ও সেরা সময়

  • কীভাবে পড়বেন: দরুদ পাঠের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আদব, আন্তরিকতা এবং ভালোবাসা। পূর্ণ মনোযোগের সাথে, রাসূল (ﷺ)-এর প্রতিচ্ছবি হৃদয়ে ধারণ করে দরুদ পাঠ করুন।
  • কখন পড়বেন: দরুদ যেকোনো সময়ই পাঠ করা যায়। তবে কিছু সময় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ:
    • জুমার দিন: রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিনই সর্বোত্তম… সুতরাং, এই দিনে আমার উপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ কর।”
    • আযানের পর: আযানের জবাব দেওয়ার পর দরুদ পাঠ করা সুন্নাহ।
    • দোয়ার শুরুতে ও শেষে: দোয়া কবুলের জন্য।
    • যখনই রাসূল (ﷺ)-এর নাম উচ্চারিত হয়: তাঁর নাম শোনার সাথে সাথে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলুন।
    • সকাল-সন্ধ্যার জিকিরের অংশ হিসেবে।

সবচেয়ে ফজিলাতপূর্ণ দরুদ কোনটি?

সকল দরুদই উত্তম। তবে, রাসূল (ﷺ) নিজে যেটি শিখিয়েছেন এবং যা আমরা সালাতে পাঠ করি, সেটিই সর্বোত্তম দরুদ।

  • দরুদে ইবরাহীম (সর্বোত্তম দরুদ):
    ٱللَّٰهُمَّ صَلِّ عَلَىٰ مُحَمَّدٍ وَعَلَىٰ آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَعَلَىٰ آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ ٱللَّٰهُمَّ بَارِكْ عَلَىٰ مُحَمَّدٍ وَعَلَىٰ آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَعَلَىٰ آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
    (এর অর্থ এবং উচ্চারণ আর্টিকেলে বিস্তারিত থাকবে)।
  • ছোট দরুদ (সবচেয়ে সহজ):
    صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
    সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
    রাসূল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত নাযিল করেন।”

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

উত্তর: রাসূল (ﷺ)-এর প্রশংসায় কবিতা বা নাশিদ পাঠ করা জায়েজ, যদি তাতে শরীয়ত বিরোধী কোনো কথা বা বাদ্যযন্ত্র না থাকে। তবে, দরুদ শরীফকে গানের সুরে বিকৃত করে পাঠ করা এবং এটিকে মূল ইবাদতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া

উত্তর: এর কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। আপনি যত বেশি পাঠ করবেন, ততই আপনার জন্য কল্যাণ। আপনি নিজের জন্য একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেন, যেমন: প্রতিদিন ১০০ বার, ৩০০ বার বা তারও বেশি। মূল বিষয় হলো ধারাবাহিকতা।

উপসংহার

দরুদ শরীফ শুধু একটি জিকির নয়; এটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে আমাদের ভালোবাসার সেতু। এটি আল্লাহর রহমত লাভের চাবিকাঠি এবং আমাদের সকল দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে মুক্তির অমোঘ ঔষধ। যে ব্যক্তি তার জীবনের একটি বড় অংশ দরুদের জন্য ব্যয় করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের সকল দায়িত্ব নিয়ে নেবেন।

আসুন, আমরা এই সহজ কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী আমলটিকে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করি এবং দুনিয়া ও আখিরাতে রাসূল (ﷺ)-এর নৈকট্য ও শাফায়াত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করি।

আরোও পড়ুন…….

🕋 আমাদের পছন্দের কিছু ইসলামিক পণ্য

এই লিঙ্কগুলো থেকে কেনাকাটা করলে সাইটটির সাপোর্ট হয়, আপনার কোনো অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই। জাযাকাল্লাহু খাইরান।

About The Author