ভূমিকা
রবিউল আউয়াল—চান্দ্র বছরের তৃতীয় মাস। এই মাসটি আসলেই মুসলিমদের অন্তরে এক বিশেষ আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে উপস্থিত হয়। কারণ, এই মাসেই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন মানবজাতির জন্য আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার, রহমাতের মূর্ত প্রতীক, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)। তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা, তাঁর কথা স্মরণ করা নিঃসন্দেহে ঈমানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ভালোবাসা প্রকাশের পদ্ধতি কি আমাদের আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, নাকি শরীয়ত দ্বারা নির্দেশিত হবে? বর্তমান সময়ে, বিশেষ করে এই মাসে, রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম-মৃত্যুর তারিখ নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি এবং “ঈদে মিলাদুন্নবী” নামক একটি প্রথা মুসলিম সমাজে প্রচলিত আছে। এই প্রবন্ধে আমরা কোনো রকম আবেগতাড়িত না হয়ে, শুধুমাত্র সহীহ দলিল, নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক প্রমাণ এবং unbiased গবেষণার ভিত্তিতে সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করব। আমাদের লক্ষ্য হলো, পাঠকদেরকে সকল প্রকার বিভ্রান্তি ও বিদআত থেকে রক্ষা করে রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ভালোবাসার সঠিক ইসলামী পদ্ধতিটি শেখানো।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম: তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি ও বিশুদ্ধ মত
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম তারিখ নিয়ে মুসলিম স্কলার এবং ঐতিহাসিকদের মধ্যে একাধিক মত প্রচলিত আছে।
প্রসিদ্ধ কিন্তু দুর্বল মত: ১২ই রবিউল আউয়াল
মুসলিম সমাজে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত হলো, রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম ১২ই রবিউল আউয়াল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই মতটির স্বপক্ষে কোনো সহীহ হাদীস নেই। এটি মূলত পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকদের বর্ণনা, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলেন ইবনে ইসহাক। তবে তিনি নিজেও কোনো সনদ বা নির্ভরযোগ্য সূত্র উল্লেখ করেননি। তাই, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বর্ণনাটি শক্তিশালী নয়।
নির্ভরযোগ্য গবেষকদের মত: ৯ই রবিউল আউয়াল
আধুনিক যুগের সিরাত গবেষক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গাণিতিক হিসাব-নিকাশ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, রাসূল (ﷺ)-এর জন্মের বছর (হাতির বছর) রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে সোমবার ছিল না।
- মিশরীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাহমুদ পাশা ফালাকি তাঁর গবেষণায় প্রমাণ করেন যে, হাতির বছর রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ, সোমবার ছিল, যা ইংরেজি ২২শে এপ্রিল, ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের সাথে মিলে যায়।
- বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিরাত গবেষক, আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ “আর-রাহীকুল মাখতুম”-এ এই মতটিকেই সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং নির্ভরযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।
মূল শিক্ষা: দিন, তারিখ নয়
নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে মতভেদ থাকলেও, তিনি যে সোমবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে যখন সোমবার রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, “এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এই দিনেই আমার উপর (প্রথম) ওহী নাজিল হয়েছে।” (সহীহ মুসলিম)
এ থেকে বোঝা যায়, তিনি নির্দিষ্ট তারিখকে নয়, বরং তাঁর জন্মের ‘দিন’টিকে রোজা রাখার মাধ্যমে স্মরণ করতেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাত: যে তারিখটি প্রায় সুনিশ্চিত
রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম তারিখ নিয়ে মতভেদ থাকলেও, তাঁর ওফাতের তারিখ নিয়ে প্রায় সকল নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক এবং সিরাত বিশেষজ্ঞ একমত।
- ঐতিহাসিকদের ঐকমত্য: ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, ইমাম ইবনে কাসির (রহঃ)-সহ প্রায় সকল ঐতিহাসিক একমত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাত হয়েছিল একাদশ হিজরির ১২ই রবিউল আউয়াল, সোমবার।
- একটি চিন্তার খোরাক: যে দিনে মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানুষটি, যাঁর মৃত্যুতে সাহাবায়ে কেরাম শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন, সেই দিনটি কি সত্যিই “ঈদ” বা আনন্দের দিন হতে পারে? একজন মুমিন কি এই দিনে আনন্দ-উৎসব করতে পারে? বিবেকবান পাঠকের কাছেই এই প্রশ্নটি রইলো।
“ঈদে মিলাদুন্নবী”: ভালোবাসার প্রকাশ নাকি বিদআতের অনুপ্রবেশ?
“ঈদ” শব্দের ইসলামী ধারণা
ইসলামে “ঈদ” বা বাৎসরিক উৎসব মাত্র দুটি, যা স্বয়ং রাসূল (ﷺ) নির্ধারণ করে দিয়েছেন: ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা। এর বাইরে তৃতীয় কোনো দিবসকে ‘ঈদ’ হিসেবে পালন করার কোনো শরঈ’ ভিত্তি নেই।
সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও ইমামদের যুগে এর অস্তিত্ব
রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ভালোবাসা আমাদের চেয়ে লক্ষ-কোটি গুণ বেশি থাকা সত্ত্বেও, তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষ—আবু বকর (রাঃ), উমার (রাঃ), উসমান (রাঃ), আলী (রাঃ)-সহ কোনো সাহাবী, কোনো তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন এবং ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ)-এর কেউই কি কখনো তাঁর জন্মদিন বা “ঈদে মিলাদুন্নবী” পালন করেছেন? উত্তর না। ইসলামের স্বর্ণযুগের প্রথম ৬০০ বছরে এর কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
মিলাদ এর প্রচলন
ঐতিহাসিকভাবে, “মিলাদ” প্রথার প্রচলন ঘটে হিজরি চতুর্থ শতাব্দীতে, উবাইদিয়া (ফাতিমীয়) নামক এক ভ্রান্ত শিয়া খেলাফতের মাধ্যমে। পরবর্তীতে হিজরি সপ্তম শতাব্দীতে, ইরাকের মসুল শহরের গভর্নর মালিক মুজাফফর আবু সাঈদ কাওকাবুরী এটিকে একটি জমকালো বার্ষিক উৎসবে পরিণত করেন। এভাবেই এই প্রথাটি মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করে।
বিদআত কী এবং কেন তা বর্জনীয়?
“বিদআত” হলো দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কোনো কাজকে ইবাদত মনে করে চালু করা, যার কোনো অস্তিত্ব রাসূল (ﷺ) বা সাহাবীদের যুগে ছিল না। রাসূল (ﷺ) এ ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করে বলেছেন:
“দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক নতুন কাজই বিদআত, প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।” (সুনানে আবু দাউদ)
রবিউল আউয়াল মাসে আমাদের করণীয়: নবীপ্রেমের সঠিক রূপরেখা
তাহলে, রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের সঠিক উপায় কী? ইসলাম আমাদের কিছু সুন্দর এবং অর্থবহ পথের দিশা দেয়:
- রাসূল (ﷺ)-এর সীরাত (জীবনী) পাঠ ও আলোচনা: এই মাসে তাঁর সংগ্রামী জীবন, তাঁর আদর্শ, তাঁর দয়া ও ক্ষমার গুণাবলী নিয়ে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে আলোচনা করুন।
- তাঁর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে—ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে আবার ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত—তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করার নতুন করে প্রতিজ্ঞা করুন।
- বেশি বেশি দরুদ শরীফ পাঠ: তাঁর উপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি কামনা করুন। এটি নবীপ্রেমের অন্যতম সেরা প্রকাশ।
- তাঁর দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেওয়া: তিনি যে শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন, তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করুন।
- সোমবার রোজা রাখা: রাসূল (ﷺ) নিজে যেভাবে তাঁর জন্মের দিনকে স্মরণ করতেন, সেভাবে প্রতি সোমবার (সম্ভব হলে) রোজা রাখুন।
রবিউল আউয়াল নিয়ে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
প্রশ্ন ২: 'মিলাদ' বা নবীজির প্রশংসায় কবিতা পাঠ করা কি জায়েজ?
উত্তর: হ্যাঁ, রাসূল (ﷺ)-এর প্রশংসায় কবিতা পাঠ করা বা তাঁর গুণাবলী আলোচনা করা একটি অত্যন্ত উত্তম কাজ। সমস্যাটি 'মিলাদ' বা প্রশংসা নিয়ে নয়, বরং সমস্যা হলো এটিকে একটি নির্দিষ্ট প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতায় (ঈদে মিলাদুন্নবী) সীমাবদ্ধ করা, যা সাহাবীদের যুগে ছিল না।
প্রশ্ন ৩: ১২ই রবিউল আউয়াল যদি নবীজির ওফাত দিবস হয়, তাহলে এই দিনে আনন্দ মিছিল করা কি শোকের দিনে উল্লাস করার মতো নয়?
উত্তর: হ্যাঁ, নির্ভরযোগ্য মতানুসারে ১২ই রবিউল আউয়াল রাসূল (ﷺ)-এর ওফাত দিবস, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বড় শোকের দিন। সেই হিসেবে, এই দিনে আনন্দ-উৎসব করাটা ইসলামের ভাবগাম্ভীর্য এবং রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ভালোবাসার সঠিক রূপের সাথে একেবারেই বেমানান।
প্রশ্ন ৪: তাহলে কি রাসূল (ﷺ)-এর আগমনে আমরা আনন্দিত হব না?
উত্তর: অবশ্যই আনন্দিত হব। তবে এই নিয়ামতের জন্য শুকরিয়া আদায় করতে হবে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে—তাঁর সুন্নাহর অনুসরণ করার মাধ্যমে, শুধু বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে আনুষ্ঠানিকতা পালনের মাধ্যমে নয়।
উপসংহার
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ভালোবাসা আমাদের ঈমানের প্রাণ। কিন্তু এই ভালোবাসা প্রকাশের পদ্ধতিও তাঁরই দেখানো পথে হতে হবে। জন্মদিন পালনের মতো আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে, জীবনের প্রতিটি দিনে, প্রতিটি কাজে তাঁর সুন্নাহকে অনুসরণ করাই হলো নবীপ্রেমের সর্বোত্তম এবং সর্বোচ্চ প্রকাশ। আসুন, এই রবিউল আউয়াল মাসে আমরা সকল প্রকার বিদআতী আনুষ্ঠানিকতা পরিহার করে, সীরাত চর্চা এবং সুন্নাহর অনুসরণের মাধ্যমে আমাদের নবীপ্রেমকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাই।
আরোও পড়ুন…….
🕋 আমাদের পছন্দের কিছু ইসলামিক পণ্য
এই লিঙ্কগুলো থেকে কেনাকাটা করলে সাইটটির সাপোর্ট হয়, আপনার কোনো অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই। জাযাকাল্লাহু খাইরান।
- সুন্দর এবং আরামদায়ক জায়নামাজ: এখানে দেখুন
- খাঁটি এবং অ্যালকোহল-মুক্ত আতর: এখানে দেখুন
- মানসম্মত টুপি/টুপি সেট: এখানে দেখুন
- ডিজিটাল তাসবীহ/গণনা যন্ত্র: এখানে দেখুন